১৯৭১ সালে ভাষাসৈনিক রাজশাহী কলেজের প্রাক্তন ছাত্রনেতা তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার খেেট্টশ^র গ্রামের লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম রাজশাহী জেলার তৎকালীন নাটোর মহকুমার লালপুর থানার গোপালপুর সুগার মিলের ম্যানেজার। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সংগঠকদের সাথে তার যোগাযোগ গড়ে উঠে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা পাবনা থেকে পালিয়ে রাজশাহী আসার সময় ময়না গ্রামে স্বাধীনতাকামীদের প্রতিরোধে পড়ে হত্যাযোগ্য চালায়। মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর রাজা আসলাম ও সুবেদার গুলবাহার মেয়ে সেজে পালিয়ে যাবার সময় ধরে পড়ে যায়। তাদের নর্থবেঙ্গল সুগার মিলে আনার পর স্বাধীনতাকামীরা জোর করে তাদের লালপুরে নিয়ে গেলে প্রমাণ সাপেক্ষে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর অপরাধে জনরায়ে তাদের প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়া হয়।
রাজশাহী ও নাটোরে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। উল্লেখ্য নাটোর অঞ্চলের অবাঙালী দোসর হাফেজ আব্দুল রহমান অসহোযোগ আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় নাটোর ছাতনী ইউনিয়ন আক্রমণ করার পরীকল্পনা করলে বাঙালি দোসরা রাজী না হলে আব্দুল রহমান পাকিস্তানি সৈন্যেেদর নিয়ে ৪মে মধ্যরাতে গ্রামবাসীরা যখন ঘুমা”িছলেন তখন মিটিং আছে বলে সকলকে ঘর থেকে বের করে ভাবনী সুইচ গেটে যেতে বলে। মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রসুলের তথ্যে জানা আতঙ্কিত নারী বয়স্ক ও শিশুরা খোলা জায়গায় আশ্রয় নিতে থাকে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যাযঙ্গ চালাতে থাকে। ভাবনী সুইচ গেটে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া লোকজনকে হাত, পা, চোখ বেধে লাইন করে বসিয়ে আব্দুর রহমান ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেছন থেকে হত্যাযঙ্গ চালালে বি”িছন্ন হয়ে যেতে থাকে দেহগুলি। পানির জন্য ছোটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে গেল দেহগুলি। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তরুণ যুবকরা বীর মুক্তিযোদ্ধা আহাদ আলী সরকারের নেতৃত্বে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে দোসর আব্দুর রহমান ও পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। পরের দিন ৫মে পাকিস্তানি সৈন্যরা নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল আক্রমণ করার সময় শিমুলতলায় টমটম যাত্রী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের ছেলে সাংস্কৃতি অনুরাগী আনোয়ার তার ভাই আতাউর বাজারে ডাক্তার শাহদৎ আলী, আশরাফ আলী, চা বিক্রেতা সাদ্দার রহমান, ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন ও আবুল হোসেনকে হত্যা করে। তারা সুগার মিলে ঢুকে ম্যানেজার লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম সহ বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দিকে অস্ত্র ধরে বলে ‘মিটিং হোগা চালো’।
অবাঙালিরা মাথায় সাদা রুমাল বেঁধে বাঙালিদের চিনিয়ে দিতে থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ম্যানেজার আনোয়ারুল আজিম সহ সকলকে জোর করে মাটিতে বসায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন ম্যানেজার আনোয়ারুল আজিমকে জিজ্ঞাসা করে ‘কিসলিয়েতোম মেজর আসলাম কো মারা’? তিনি উত্তর দেন, ‘আমরা জানি না’। পাকিস্তানি সৈন্যরা সকলকে লেটযাও বললে সকলেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন। হিসারক্ষক আব্দুল মান্নান কোরআন তেলোয়াত করতে থাকলে পাকিস্তানি সৈন্যরা বলে, ‘স্যালে কোরআন ভি পড়নে জানতা? তোমমি লেট যাও’। তারা সকলকে এলোপাথাড়িভাবে মারতে থাকে। মিল ম্যানেজারকে চাপ দিতে থাকলে তিনি আবারো বলেন, ‘আমরা জানি না’।
পাকিস্তানি সৈন্যরা সকলকে উঠে দাঁড়াতে বললে আবাঙালি ইদুয়া কি যেন বললে তারা সকলকে গোপালপুকুরের কাছে নিয়ে গিয়ে পাঁচ মিনিট গুলি চালাতে থাকলে কারো মাথা, কারো দেহ বি”িছন্ন হয়ে গেল। যারা রক্ষা পাবার জন্য পুকুরে লাফ দেন তারা তাদের ও গুলি করে। বেঁচে যাওয়াদের বাশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। গোপাল পুকুর রক্তে লাল হয়ে গেল। স্বাধীনতাকামীদের খুঁজতে ম্যানেজারের বাড়ি আক্রমণ হবে শুনতে পেয়ে পরি”ছন্ন কর্মী ভিখুর স্ত্রী শান্তিরাণী, ম্যানেজারের স্ত্রী নুরনাহারকে তাদের মতো করে শাড়ি পরিয়ে রক্ষা করেন। খন্দকার জালাল আহমেদ ও তার বাবা খন্দকার ঈমাম উদ্দীন আহত হয়ে বেঁচে গেলেও ছোট ভাই আব্দুল মান্নান শহিদ হলেন। খন্দকার জালাল আহমেদ তিনটা মৃতদেহের নিচে চাপা পড়লেও পাকিস্তানি সৈন্যরা ‘শালে জিন্দা হ্যায়’ বলে ট্রেনে উঠিয়ে দুইবার বেয়েনট চার্জ করে। তিনি চিৎকার দিয়ে পড়ে যান।
তিনি মারা গেছেন মনে করে, তারা তাকে পুকুরে ফেলে দেয়। তিনি জ্ঞান ফিরে দেখেন সিড়িতে তুলে দিয়েছেন। চারিদিকের ভয়াবহ অব¯’া দেখে কাঁদলেন। সাহয্য করার মতো কেউ নাই। একহাত ও একপায়ে ভর করে চার ঘন্টায় ড্রেনের ঝোপের মধ্যে দিয়ে দেড়শো হাত রাস্তা পার হয়ে গাছের নিচে মেহমান আলী ও গার্ড নওশাদকে পেয়ে তাদেরকে প্রাচীরের ওপারে ফেলে দিতে অনুরোধ করলে উনারা কষ্ট করে তাই করেন। জ্ঞান ফিরে জালাল আহমেদ দেখেন দুজন তাকে ঘাড়ে করে বাড়িতে পৌছে দিয়ে গেল। জলিল শিকদার দেখলেন, আহতরা গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করছেন।
আহত হিসাবরক্ষক সাইফুদ্দীন আহমেদ ও হেডক্যাশিয়ার নুরুল আসলাম পুকুরের পানিতে তলিয়ে গেলেন। পুকুরের পানিতে থাকা প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহিদ সাহেবের নিচের অংশ গুলিবিদ্ধ। গুলিবিদ্ধ হাতের প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে প্রাচীর পার হবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে চারজনের সাহয্যে সোলেমান সরকারের বাড়িতে গেয়ে পরের দিন চিকাদহ গ্রামে আবুল সোহরাবের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ৯মে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরুমপুর হাসপাতালে ভর্তি হন। গোপালপুকুর এখন শহিদ সাগর। রেলস্টেশনটি শহিদ আজিমনগর। মিলটির প্রাক্তন কর্মচারী শ্রমিকনেতা স্বপন কুমার পাল দুঃখ করে বলেন। গোপালপুকুর এখন শহিদ সাগর, গোপালপুর রেলস্টেশন শহিদ আজিমনগর। কিš‘ সেদিন যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, পঙ্গু হয়েছেন তাদের কথা কয়জন মনে রেখেছেন, কয়জন পরিবারগুলির খোজখবর নেন। তার প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুর সবকিছু বন্ধু রাখতে নির্দেশ দেন। কিš‘ ষড়যন্ত্রকারীরা কৌশলে মিলটি খুঁলে রাখায় যা ঘটেছে এর দায়-দায়িত্ব কে নিবে। তথ্যসূত্র: খন্দকার জালাল আহমেদ, জলিল শিকদার, স্বপন কুমার পাল।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক, রাজশাহী, ০১৯১১-৮৯৪২৬০