নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন আগামীকাল ১৮ সেপ্টেম্বর। ইতোমধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই পদের জন্য ৯৪ জন পদ-প্রত্যাশীদের জীবন বৃত্তান্ত জমা হয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে। তবে এসব পদ পেতে আলোচনায় আছেন প্রার্থীর মধ্যে ১০-১২ জন নেতা। এদের মধ্যে অধিকাংশেরই বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হয়েছে। আবার কিছু নেতা ঝরেপড়া বা ড্রপ আউট হয়েছে। এখন তারা পদ পেতে কেউ সান্ধ্যকালীন কোর্স বা কেউ শর্ট কোর্সে ভর্তি থেকে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। তবে এসব প্রার্থীদের পদে পদায়ন করলে ছাত্রলীগের গঠণতন্ত্র লঙ্ঘন হবে বলে মনে করছেন বর্তমান নেতারা। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বলছে, তাদের কাছে জমা পড়া জীবনবৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করে, পর্যালচনা করে, পর্যবেক্ষণ করে তারা কমিটি গঠন করবে।
বিশ^বিদ্যালয় দলীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ এক যুগ পর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ১০-১২ জন ছাত্রনেতা আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচণায় আছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি কাজী আমিনুল হক লিংকন ও মেজবাহুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন, মেহেদী হাসান মিশু, গনযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ, উপ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক তাওহীদ দূর্জয়। তবে নেতৃত্বের দৌঁড়ে এগিয়ে থাকা এসব নেতাদের অধিকাংশের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অনেক আগেই। আবার অনেকে হয়েছেন ড্রপআউট।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কাজী আমিনুল ইসলাম লিংকন এবারের সম্মেলনে সভাপতি পদপ্রত্যাশী। তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালে অনার্স শেষ করেছেন এবং ২০২১ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এখন ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ভর্তি আছেন মার্কেটিং বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বর্তমান যে কমিটি সেটা ২০১৬ সালের কমিটি। তো সেই ক্ষেত্রে সম্মেলন যারা পায়নি অর্থাৎ অনেকে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েও সম্মেলন দেখেনি। এই সাংগঠনিক জটে অনেকেরই পড়ালেখা শেষ হয়ে গেছে। এখন অনেকে ডিপার্টমেন্টের অন্য কোর্সগুলোতে ভর্তি হয়ে আছে। আমারও পড়ালেখা শেষ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আইন তো মানুষের জন্য, মানুষ তো আইনের জন্য না। যেহেতু বর্তমান কমিটি ২০১৬ সালের তাই এখনে কারোরই ছাত্রত্ব থাকার কথা না। তবে ছাত্রত্ব থাকা না আর পড়াশোনা শেষ এর ভেতরে কিন্তু পার্থক্য আছে। আমি অন্যদের কথা বলতে পারছি না। তবে আমি এখনও আমার বিভাগে ভর্তি হয়ে আছি। এখন এটাকে সাবেকও বলতে পারেন আবার বর্তমান শিক্ষার্থীও বলতে পারেন।
সহ-সভাপতি মেসবাহুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে অনার্স এবং পরের বছর মাস্টার্স শেষ করেন। তিনি সভাপতি পদের জন্য প্রার্থী হিসেবে আছেন। তিনিও বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ের ইংলিশ এন্ড আদার ল্যাংগুয়েজ এর শর্ট কোর্সে ভর্তি আছেন। এ বিষয়ে মেসবাহকে একধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন। তিনিও সভাপতি পদ প্রত্যাশা করছেন। তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। সরকার ডন ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে ২০১৬ সালে অনার্স এবং ২০১৮ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানের তিনি ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজের জার্মান ভাষার শর্ট কোর্সে ভর্তি রয়েছেন।
এ বিষয়ে সরকার ডন বলেন, লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর প্রথমে ফ্রেন্স ল্যাংগুয়েজে ভর্তি হয়েছিলাম। সেটা শেষ হওয়ার পর এখন জার্মান ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। এটার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কিন্তু আমি পরীক্ষা দেইনি। আমার লেখাপড়া শেষ হলেও এখানে একটা বয়সের বিষয় আছে। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমার বয়স এখনও এক মাস আছে। আর আমিতো ড্রপ আউট না বা ইন্টার পাশ না। বিবিএ এবং এমবিএ শেষ করেছি নিয়মিতভাবে। আমার ছাত্রত্ব এখনও আছে।
এদিকে সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী হিসেবে বেশ আলোচনায় আছেন শাখার গনযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবু। বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালে অনার্স এবং পরের বছর মাস্টার্স শেষ করেছেন। তবে এখন ছাত্রত্ব ধরে রাখতে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ইংলিশ এন্ড আদার ল্যাংগুয়েজ এর শর্ট কোর্সে ভর্তি আছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমিতো অছাত্র না আমি আদার ল্যাংগুয়েজ কোর্সে ভর্তি আছি। বিশ^বিদ্যালয়ের নিয়মে এখানে যারা অনার্স শেষ করে তারা যেকোনো কোর্সে ভর্তি হতে পারে। আমিতো বলিনি আমি অছাত্র। এখানে যারা গবেষণা করে, পিএইচডি করে তারাও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বাবু। তিনি বলেন, এটাতে তোমাদের জানার ভুল আছে। করোনার মধ্যে কে ক্যাম্পাসে ছিল?
ড্রপআউট দুই নেতা
সাধারণ সম্পাদক পদের দৌঁড়ে বেশ এগিয়ে থাকা বর্তমান কমিটির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লা হিল গালিব। গালিব বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তবে ড্রপ আউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন তিনি। এরপর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি আছেন বলে তিনি একাধিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। অভিযোগ আছে ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপাতত কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে বর্তমানে আমি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি আছি।’
এদিকে ড্রপ আউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছেন সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু। বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সিট বানিজ্য, দোকান ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে এক শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে নাফিউল ইসলাম জীবন নামের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে।
তবে তাকে ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, অছাত্ররা কিংবা ড্রপ আউটের বিষয়টি সংগঠনের গঠনতন্ত্রের সম্পুর্ণ বিরোধী। অবশ্যই তাকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হতে হবে। গঠনতন্ত্রের যে নিয়ম-নীতিগুলো আছে সেগুলো পূর্ণ না করে কেউ যদি প্রার্থী হতে চাই সেটা তার বিষয়। তবে প্রার্থী নির্বাচন করবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক ও আলোচনা সাপেক্ষে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন সাহেব। তাদের প্রতি আমাদের এতটুকু বিশ^াস আছে যে তারা এমন নেতৃত্ব নির্বাচন করবে, যাদের বিশ^বিদ্যালয়ের রাজনীতি করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, আগামীদিনের প্রতিকূল সময়ে কিভাবে সংগঠনকে গতিশীল করা যায়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের যে ঐতিহ্য সেটাকে বজায় রাখবে তাদেরকেই তারা নেতৃত্বে নিয়ে আসবে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই তারা রাজশাহী বিশ^দ্যিালয়ের নেতৃত্ব নিয়ে আসবেন আশা করি।
সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, আমাদের কাছে জমা পড়া জীবনবৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করে, পর্যালচনা করে, পর্যবেক্ষণ করে আমরা কমিটি গঠন করবো। একটি সুন্দর, সৃজনশীল, শিক্ষার শুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় গড়ার লক্ষে, স্মার্ট রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় গড়ার লক্ষে যে শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ ভুমিকা রাখতে পারবে তাদেরকেই, যারা শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির ধারক বাহক হবেন তারাই নির্বাচিত হবেন।
কোনো শর্ট কোর্সে ভর্তি, ড্রপআউট শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বে আসবে কি না? এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, দেখুন আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। তবে জীবন বৃত্তান্ত বিচার বিশ্লেষণ করেই রাবি শাখার কমিটি করা হবে। কমিটি হওয়ার পর যদি কোনো অসঙ্গতি পান তখন আপনি আপনার সংবাদ পত্রের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরবেন।
উল্লেখ্য, বিশ^বিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্স বা ল্যাংগুয়েজ কোর্স এমন একটি বিষয় যেখানে শুধু বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না বাইরের শিক্ষার্থীরাও চাইলে ভর্তি হতে পারেন।