নিজস্ব প্রতিবেদক
‘রোদে আমারে শরীর পুইড়ে যায়। বারবার পানি খাতি হয়। কী করব বলেন, বসে তো আর থাকতি পারি না। এমনিই সংসার চলে না, কাজে না এলে কীভাবে সংসার চলিবে।’ রাজশাহী নগরের বিনোদপুর এলাকায় সড়ক বিভাজকে কোদাল দিয়ে মাটি কোপাতে কোপাতে কথাগুলো বলছিলেন দিনমজুর মকবুল হোসেন। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার জয়পুর গ্রামে। প্রতিদিন সকাল সাতটায় কাজে আসেন। বাড়ি ফেরেন বিকেলের দিকে। প্রতিদিন আয় হয় ৬০০ টাকা।
মকবুল হোসেন আরও বলেন, যাঁরা কাজ দেন, তাঁরা রোদ দেখেন না। রোদ বেশি থাকলে টাকা বেশি দেওয়া হয় না। বাড়ি থেকে খাবার এনে খেতে হয়। রোদের কারণে পাশেই থাকা একটি টিউবওয়েল থেকে ঘন ঘন পানি পান করছিলেন এই দিনমজুর। বলেন, গরমে টিউবওয়েলেও পানি ওঠে কম।
মকবুলের সঙ্গে আরও কয়েকজন কাজ করছিলেন। তাঁদের কারও বাড়ি পুঠিয়ায়, কারও চারঘাটে। শাহ্ আলম নামের চারঘাটের একজন শ্রমিক বলেন, মাথায় গামছা বেঁধে দেওয়ায় মাথা একটু রক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু শরীর দিয়ে মনে হচ্ছে সব পানি বের হয়ে যাচ্ছে।
মো. মন্টু নামের শ্রমিক বলেন, ‘ভাই, এত কষ্ট করে কাজে এসে ঘাম ঝরাচ্ছি। টাকা মাত্র ৬০০। এই টাকা দিয়া বাজারসদাই করা যায় না। খুব কষ্টে কাটছে দিন।’
রাজশাহীতে কয়েক দিন ধরে চলছিল মৃদু তাপপ্রবাহ। তা বেড়ে গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার রূপ নেয় তীব্র তাপপ্রবাহে। এ দাবদাহে সবচেয়ে কষ্টে আছেন শ্রমজীবী মানুষেরা। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে লোডশেডিং। এক সপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে গ্রাম ও শহরে লোডশেডিং বেড়েছে। এলাকাভেদে টানা এক ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে।
নগরের বুধপাড়া এলাকার রহিদুল ইসলাম বলেন, কয়েক দিন ধরে রাত ১২টার পর বিদ্যুৎ চলে যায়। আজ আবার সকালে এক ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ ছিল না। গরমে বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘরে থাকা যায় না।
রাজশাহী নগরের কাজলা এলাকায় একটি গলির রাস্তায় কয়েকজন রিকশাচালক বসে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রচণ্ড দাবদাহে মানুষ বাইরে কম বের হয়েছেন। এ কারণে তাঁরা যাত্রী পাচ্ছেন না।
মো. ইয়াসিন নামের একজন রিকশাচালক বলেন, দিনে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। গরমের কারণে যাত্রী না পেয়ে আয় কমে গেছে। সকালে আর সন্ধ্যায় মানুষ বের হয় বেশি। ওই সময় একটু ভাড়া পাওয়া যায়।
নগরের কুমারপাড়া এলাকায় মো. ইলিয়াস আখের রস বিক্রি করছিলেন। পথচারী ও রিকশাচালকেরা তাঁর প্রধান ক্রেতা। নাহিদ নামের এক পথচারী বলেন, এই গরমে শরীর ঠিক রাখতে হলে প্রচুর তরল পান করতে হয়।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে সর্বশেষ বৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১০ দিন আগে। এরপর থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। গত সোমবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ছিল ওই দিনের সারা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
এরপর মঙ্গলবার ১ ডিগ্রি বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। আর তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে তাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ গণ্য করা হয়। তাপ ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি হলে তীব্র তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। আর ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রা উঠে গেলে তা হয় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।
এখনই বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই জানিয়ে রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়া পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম বলেন, আজ শনিবার বেলা পৌনে একটায় তাপমাত্রা উঠেছে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তাঁরা দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পরিমাপ করেন বেলা তিনটার দিকে। রাজশাহীতে এই আবহাওয়া অব্যাহত থাকবে।
রাজশাহীতে গ্রামে রাজশাহী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এবং মহানগর আর উপজেলা শহরে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।
রাজশাহীতে গ্রাহক পর্যায়ে নেসকোর বিদ্যুতের চাহিদা ৯০ থেকে ১১৫ মেগাওয়াট। বৃষ্টি হলে এই চাহিদা কমে আসে। গরমের কারণে ঘাটতি হয়ে যাচ্ছে ২০ মেগাওয়াট পর্যন্ত। এই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে লোডশেডিং দিয়ে। আর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রামাঞ্চলে দিনের বেলায় ৪৫-৫০ মেগাওয়াট আর রাতের বেলায় ৬০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন পড়ে। পল্লী বিদ্যুতে ঘাটতি আছে ৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত।
নেসকোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, এখন রাজশাহীতে খুব গরম পড়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুতের পুরো চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। এ কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। রাজশাহী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার রমেন্দ্র চন্দ্র রায় বলেন, গ্যাস–সংকটে কিছুটা লোডশেডিং হচ্ছে।