‘ঈদ তো আমাদের হবে না, ঈদ কেমন করে হবে বলেন? আমরা মাসের পর মাস খেটে পানের বরজ রেডি করেছি। ঈদের এ সময় পান ভাঙবো, বিক্রি করে ঈদের বাজার করে বাড়িতে নিয়ে যাব এমন আশায়। অথচ বরজে একটা পানও নাই। আমরা একটা পানও ভাঙতে পারলাম না, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাহলে আমাদের কী করে ঈদ হবে বলেন? আমরা নিরুপায়, আমাদের কোনো ব্যবস্থা নাই। আমাদের ঈদের আনন্দ আগুনে পুড়ে ছাই।’
মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) দুপুর ১২টার দিকে কান্নাজড়িত কন্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পান চাষি মোজাফফর হোসেন। তিনি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার দেলুয়াবাড়ি ইউনিয়নের বখতিয়ারপুর গ্রামের বাসিন্দা। মোজাফফর হোসেনের এক বিঘা জমির পানের বরজ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এর আগে গতকাল সোমবার (৮ এপ্রিল) দুপুরে বখতিয়ারপুর গ্রামে পানের বরজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪২ জন পান চাষির বরজ পড়ে গেছে।
মোজাফফর হোসেন বলেন, মনে করেছিলাম আজ পান ভেঙে ঢাকায় পাঠাব। কিন্তু তা পারলাম না। আমারসহ কয়েকশ বিঘা পানের বরজ পুড়ে গেছে। বরজের একটিও পানের পাতা কাঁচা নাই যে পানটা বিক্রি করব। এখানে ৪২ জন কৃষকের পানের বরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পান ভাঙার ব্যবস্থা নাই আমাদের। এই মৌসুমে আমার তিন লাখ টাকার পান বিক্রির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আগুনে পুড়ে যাওয়ায় একটা পান নাই বরজে। আমরা ঈদের কোনো বাজার-হাট করতে পারিনি। আমরা যে কত দুঃখের কষ্টে আছি তা বলে বোঝানো যাবে না। মনে মানছে না, তাই আগুনে পোড়া পানের বরজ জীবিত করতে সকাল থেকে পানি দিচ্ছি। যদি একটা পানের গাছ বাঁচে, তাহলে লাগানো খরচ বেঁচে যাব। এখন এক বিঘা পানের বরজ তৈরি করতে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা খরচ। এই টাকা আমরা পাব কোথায়।
স্থানীয়রা জানান, গতকাল সোমবার দুপুরে হঠাৎ করেই পানের বরজে আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যেই একের পর এক পান বরজে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে ৪২ জন চাষির প্রায় ১০০ বিঘা পানের বরজ নিমিষেই পুড়ে যায়। পরে খবর পেয়ে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস।
সরেজমিনে বখতিয়ারপুর গ্রামে গিয়ে আগুনে পোড়া পানের বরজগুলোতে চাষিদের কাজ করতে দেখা গেছে। তারা পানির বরজে লাগনো বাঁশ ও বাঁশের বাতাগুলো সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার আগুনে পুড়ে যাওয়া পানের বরজে পানি দিচ্ছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা জানান, খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি থেকে আরেকটি পান বরজে আগুন লেগে যায়। আগুন নেভাতে স্থানীয়রা যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবে কাজ করেছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সর্বশেষ স্থানীয়দের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যোগ দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
পান চাষি মো. ময়জুদ্দিন বলেন, রাজশাহী জেলার মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুর উপজেলায় সব থেকে বেশি পান চাষ হয়। এই এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা পান নিয়ে। কীভাবে যে আগুন ধরে এতগুলো চাষির ক্ষতি হলো কেউ জানতে পারল না আগুনের কারণ। এই চাষিগুলোর তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকার পান পুড়ে গেছে। আমরা এখন নিঃস্ব। দুইদিন পরে ঈদ, কী বাজার-হাট করব, তা বুঝে উঠতে পারছি না।
দুর্গাপুর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ফিরজ আহমেদ বলেন, ৪১ জনের পানের বরজ পুড়েছে। জমির পরিমাণ ২০ বিঘা। ক্ষতির পরিমাণ শুধু পান ৫০ লাখ। আর পান ছাড়া বরজের ক্ষতি ৩০ লাখ। কৃষি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা কৃষকদের পাশে আছেন এবং প্রণোদনার যদি কোনো সুযোগ থাকে তারা সে ব্যবস্থা করবেন।
এলাকার রহিদুল ইসলামের দোকানে বসে বেশ কিছু ক্ষতিগ্রস্ত পান চাষি তালিকা করছেন। তালিকা করার দায়িত্ব পালন করছেন আনোয়ারুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক যুবক। আগুনে তারও পানের বরজের ক্ষতি হয়েছে।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত পান চাষিদের তালিকা করছেন। ব্রাক নামে একটি এনজিও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এনজিওটি ক্ষতিগ্রস্ত পান চাষিদের তালিকা চেয়েছে। তাই তারা এলাকার মোড়ে বসে ব্র্যাক এনজিও থেকে যে গ্রাহকরা ঋণ নিয়েছিল- এমন ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা করা হচ্ছে।
ব্রাক দুর্গাপুরে কানপাড়াহাট শাখার ফিল্ড অফিসার এমদাদুল হক জানান, আমরা এর আগেও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পান চাষিদের প্রণোদনা দিয়েছি। এবারও তালিকা তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। এই তালিকায় যারা রয়েছেন তারা তাদের এনজিওর ক্রেডিট (ঋণ) প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িত।
দুর্গাপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের টিম লিডার শাহিনুল ইসলাম জানানু, খবর পেয়ে আগুন নেভাতে যায় ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু তার আগেই প্রায় ১০০ বিঘা জমির পানের বরজ পুড়ে গেছে। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
দুর্গাপুর উপজেলার ৪ নম্বর দেলুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন কোনো সুযোগ থাকলে প্রণোদনা দেওয়া হবে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা চেয়েছেন। আমরা তাকে আজকে তালিকা দেব। এ ঘটনায় পান চাষিদের ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিমের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।