প্রথম ছয় দিন প্রত্যাশা অনুযায়ী ঈদযাত্রা ছিল কিছুটা স্বস্তিদায়ক এবং নিরাপদ। ষষ্ঠ দিন সোমবার (৮ এপ্রিল) রাতে কমলাপুর রেলস্টেশনে কড়াকড়ি আর ধরে রাখা যায়নি অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে।
বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনগুলোর বগিতে তিল ধারণের ক্ষমতা না থাকায় যাত্রীদের ছাদে উঠতে দেখা যায়। যদিও আগে থেকেই স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার বলছিলেন, এবার ছাদে ওঠার কোনো সুযোগ নেই।
তবে আশঙ্কা ছিল সোমবার রেলের কড়াকড়িতেও কোনো কাজ হবে না, যখন যাত্রীর চাপ লাগামহীন হয়ে যাবে। অবশেষে সেই শঙ্কা সত্যি হল।
কেন কড়াকড়ি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, জানতে চাইলে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার বলেন, শেষ সময়ে পারা যায়নি। গার্মেন্টস ছুটি হওয়ায় যাত্রীর চাপ অনেক বেশি ছিল। আমরা যতদূর পেরেছি, চেষ্টা করেছি।
এদিকে কমলাপুর স্টেশনে কড়াকড়ি হলেও বিমানবন্দর স্টেশনে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির অভিযোগ রয়েছে। অনেকে টিকিট কেটে নিজের আসনে বসতে পারেননি বলেও অভিযোগ।
বাসেও বিশৃঙ্খলা
সরকারের সংশ্লিষ্টরা সড়কপথে স্বস্তির ঈদযাত্রার আশার কথা শুনিয়েছিলেন। তবে ঈদে বিভিন্ন গন্তব্যে বাড়িফেরা মানুষের চাপ বাড়তেই স্বস্তি উবে গেছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সঙ্গে প্রচুর ধুলায় ভোগান্তিতে পড়েছেন উত্তরবঙ্গগামী যাত্রীরা। দক্ষিণবঙ্গের পদ্মা সেতুর টোলাপ্লাজাতেও দীর্ঘ জট। মহাখালী বাস টার্মিনালের যাত্রীরা বাসের অপেক্ষায় পার করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
সজিব হোসেন নামে উত্তরবঙ্গের এক যাত্রী এই প্রতিবেদককে জানান, রাতে যাত্রা শুরু করে চন্দ্রা থেকে বের হতেই ভোর হয়ে যায়, আর টাঙ্গাইল পৌঁছান সকাল ৯টার দিকে। দুপুরের পর বগুড়া প্রবেশ করেন। রংপুর পৌঁছাতে আরও কয়েক ঘণ্টা লাগবে। সড়কে তীব্র ধুলা। এমন ঈদযাত্রা হতাশার।
জেলা প্রতিনিধিরা জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে রাতভর ছিল যানজট। সকালে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ভোগড়া বাইপাস ও চন্দ্রা ত্রি-মোড় ঘিরে তিন দিকেই কয়েক কিলোমিটারজুড়ে যানবাহনের ধীরগতি রয়েছে। এসব এলাকায় থেমে থেমে যানবাহন চলছে।
ঈদযাত্রায় গাড়ির চাপ বেড়েছে দক্ষিণবঙ্গের পথেও। ফলে পদ্মা সেতুর সেতুর টোল প্লাজার সামনে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।
কেন এই ভোগান্তি
যাত্রী-পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর ঈদযাত্রায় ভোগান্তির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো- কত যাত্রী ঢাকা ছাড়বেন, কবে ছাড়বেন এবং কীভাবে ছাড়বেন, সেটির যথাযথ সমীক্ষা না হওয়া। একইসঙ্গে এ যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ সামলাতে যথাযথ পরিকল্পনা না করা। অতিরিক্ত বাস যেমন নেই, তেমনি মাত্র আট জোড়া স্পেশাল ট্রেন প্রতিদিন অতিরিক্ত যাত্রী নিতে পারে মাত্র আট হাজারের মতো।
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান ২০২৩ সালে একটি সমীক্ষা করেছিলেন।
তার সমীক্ষা অনুযায়ী, ঈদের আগের চার দিনে ঢাকা ছাড়েন এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। সে হিসাবে ঈদের সময় প্রতিদিন গড়ে বাড়ি যান ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক যে গণপরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো দিয়ে বড়জোর দিনে ২২ লাখ যাত্রী পরিবহন সম্ভব।
সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে প্রায় আট লাখ মানুষ বাস-মিনিবাসে, এক লাখ পাঁচ হাজার মানুষ ট্রেনে বসে-দাঁড়িয়ে এবং সোয়া লাখ মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করেন। ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে বাড়ি যান সাড়ে সাড়ে লাখ মানুষ। মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রায় শামিল হন চার লাখ মানুষ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি পর্যবেক্ষণে বলেছিল, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে এক কোটি, গাজীপুর থেকে ৪০ লাখ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ১২ লাখসহ ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবেন। ঈদের আগের চারদিনে মিনিবাসে ৩০ লাখ, ট্রেনে চার লাখ, প্রাইভেট কার, জিপ ও মাইক্রোবাসে ৩৫ লাখ, মোটরসাইকেলে ১২ লাখ, লঞ্চে ৬০ লাখ, উড়োজাহাজে প্রায় এক লাখ যাত্রীর যাতায়াত হতে পারে।
গণপরিবহন সংকট ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যর কারণে বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে এবং খোলা ট্রাক ও পণ্যবাহী পরিবহনে ১৮ লাখ যাত্রীর যাতায়াত হতে পারে।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির ঈদপূর্ব পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বৃহত্তর ঢাকার প্রায় দেড় কোটি মানুষ স্বজনদের কাছে যাবেন। ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনসহ ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বসবাস করা বিপুলসংখ্যক ঈদযাত্রীর ৬০ শতাংশ যাবেন সড়কপথে। সেই হিসেবে সড়কপথের যাত্রীসংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ মানুষ নৌ ও রেলপথে ঢাকা ছাড়বেন।
বেসরকারি এ দুই প্রতিষ্ঠান ঈদপূর্ব সমীক্ষা করলেও সরকারি কোনো সমীক্ষা নেই। ফলে যাত্রীরা আসলেই কতজন যাবেন সেটা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাত্রীদের বাড়ি ফেরার সময়, সংখ্যা ও যানবাহনের সমন্বয় না থাকায় এ সংকট প্রতিবছর চলছে। বিশেষ করে, ঈদের দুদিন আগে যখনই গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছুটি শুরু হয়, তখনই সংকটের এ মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ নিম্নআয়ের এসব মানুষের দামি পরিবহনে চলাচলের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের তথ্য মতে, গাজীপুর, টঙ্গী, সাভার ও আশুলিয়া অঞ্চলে ২২ থেকে ২৩ লাখের মতো শ্রমিক চাকরি করেন। ঈদে যথাসময়ে বেতনভাতা পেলে ৬০ শতাংশের মতো শ্রমিক বাড়ি যেতে পারেন, বিশেষ যেসব পরিবারে একাধিকজন চাকরি করেন। অন্যদিক একা যারা কাজ করেন, তারা অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে যেতে পারেন না।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক কাজী রুহুল আমিন বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকেরা শেষ মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে পারেন না। কারণ তাদের অগ্রিম বেতন-বোনাস দেওয়া হয় না। আজও (মঙ্গলবার) অনেকে বেতন-বোনাস পাননি, শেষ মুহূর্তে পাবেন।
এজন্য যে চাপ পড়েছেন সে চাপের জন্যে বিশৃঙ্খলা হয় বলেও মত এ শ্রমিকনেতার।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, আমাদের অতিরিক্ত যাত্রী চাপ সামলানোর জন্য পরিকল্পনা নেই। ফলে সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে না। গার্মেন্টস শ্রমিকদের যাতায়াত নিয়েই সবচেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয়। চাইলেই সাময়িক যান, সিটি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যায়।
এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তো সব ঠিক রাখা সম্ভব নয়। আগেরমতো যানজট নেই।
তবে শেষে মুহূর্তে পোশাকশ্রমিকদের ছুটি হওয়ায় বিশৃঙ্খলা বেড়েছে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, চাইলেই তো এতো বাস নামানো সম্ভব নয়, এতো সক্ষমতা নেই আমাদের।