রাজশাহীতে পদ্মা নদীর বুকে জেগে ওঠা বিস্তির্ণ চর আর ফসলি জমি দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এখানে একটি প্রমত্তা নদী ছিলো। অথচ এক সময় এই নদীর বুকে ছিলো অথৈ পানি। বর্ষা মৌসুমে পাল তোলা নৌকা, জাহাজ স্টিমার চলতো যেখানে, সেখানেই এখন ফসল ফলাতে ব্যস্ত কৃষক। পদ্মা নদীর অথৈ পানির সেসব কথা এখন যেন শুধুই ইতিহাস। শিশুদের কাছে মনে হতে পারে রূপকথার গল্প। বর্ষা মৌসুম ছাড়া পদ্মা নদীর রাজশাহী পয়েন্ট পানির দেখা মেলা কষ্টকর। বছরে ২/১ মাস নদীতে পানি থাকে আর বাকী সময়জুড়ে থাকে ধুধু বালুচর। শুধু খরা মৌসুমেই নয় পদ্মা নদীতে বর্ষা মৌসুমেও পানির সরবরাহ থাকছে তুলনামুলক কম। একারনে গত এক দশকে রাজশাহী ও আশপাশের এলাকায় বন্যা হয়নি। পদ্মা নদীর এই জীর্ন দশার জন্য দায়ি ভারতের ফারাক্কা বাঁধ।
১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ভারতে ফারাক্কা বাঁধ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিন যত যাচ্ছে রুগ্ন হচ্ছে পদ্মা নদী। রাজশাহী পয়েন্টে খরা মৌসুমে পানির উচ্চতা কমেই চলেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান বলছে, ফারাক্কা বাঁধ নির্মার্ণের আগে পদ্মায় খরা মৌসুমেও পানির প্রবাহ থাকতো বেশ ভালে। ১৯৭২ সালে খরা মৌসুমে পানির উচ্চতা নেমেছিলো ১০ দশমিক ২৫ মিটার। ১৯৭৩ সালে ছিলো ৯ দশমিক ৯০ মিটার, ১৯৭৩ সালে ৯ দশমিক ৪১ মিটার, ১৯৭৪ সালে ৯ দশমিক ০৯ মিটার, ১৯৭৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ০৭ মিটারে। পরের বছর ১৯৭৬ সালে এই উচ্চতা ছিলো ৮ দশমিক ২২ মিটার। প্রতি বছর খরা মৌসুমেই এই উচ্চাতা অস্বাভাবিক নিচে নেমে যায়। এ বছর গত ১২ মে এখানকার পানির উচ্চতা নেমে যায় ৬ দশমিক ৯৫ মিটার। এন পর্যন্ত এটিই চলতি বছরে সর্বনিম্ন স্তর। আবার বর্ষা মৌসুমেও এখন আর আগের মত পানির প্রবাহ থাকে না পদ্মা নদীতে। একারণে সেভাবে আর বন্যাও হয়না।
পদ্মা পাড়ের বাসিন্দা আয়নাল হক বললেন, ছোট বেলা থেকেই তিনি পদ্মার পাড়ে বড় হয়েছেন। ফারাক্কা বাঁধ হওয়ার আগে নদীর যে জোয়ার ছিলো বাঁধ হওয়ার পর থেকেই নদীর চেহারা বদলে যেতে থাকে। এ অঞ্চলের সব চেয়ে খরস্রোতা ছিলো পদ্মা নদী। বর্ষা মৌসুমে নদীর গর্জন শোনা যেত দূরের গ্রাম থেকেও। কিন্তু নদী শুকাতে শুকাতে এখন মরা পদ্মা হয়ে গেছে। এখন বর্ষার সময়ও নদী আর ফুঁসে উঠে না। গর্জণ থাকে না। কিছুদিনের জন্য পদ্মায় পানি প্রবাহ থাকলেও আষাঢ়-শ্রাবণ শেষেই কমতে থাকে পানি। এরপর থেকে কমতে কমতে চৈত্রে এসে পরিণত হয় ধু-ধু বালুচরে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর জানান, পদ্মা নদীতে যে পানি আসছে তা আমাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। পানির অভাবে পদ্মার বুকে চর জেগেছে। শুধু পদ্মা নদী নয়, এ অঞ্চলের শাখা নদীগুলো এখন মৃত প্রায়। আগামী বছর ফারাক্কার পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এর পরই নতুন করে এটি নিয়ে আলোচনা হবে। তখন হয়তো এই বিষয়গুলো উঠে আসবে। এসব নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞজনেরা।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ভারতের তৈরী ফারাক্কার প্রভাবে এ অঞ্চলের মানুষ চরম ক্ষতির শিকার। পৃথিবীর কোন দেশের সাথে প্রতিবেশি রাষ্ট্র এমন আচরণ করেনি। তিনি বলেন, আমাদের এখন ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নিজেদের দাবির প্রতি সোচ্চার থাকতে হবে। আগামী বছর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন চুক্তি হবে। সেখানে নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কোন সুযোগ নেই। দেশের মানুষ এখন সোচ্চার। ভারতকে অবশ্যই আমাদের অধিকার দিতে বাধ্য করতে হবে।
মাহবুব সিদ্দিকী জানান, পদ্মার উজানে দেয়া ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। পদ্মা নদীতে এখন অসংখ্য চর জেগেছে। পদ্মার বেশ কিছু শাখা নদী উপ শাখা নদী মরে গেছে। ফারাক্কার সরাসরি শিকার রাজশাহীর মানুষ। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় নদীর আয়তন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে তলদেশ ক্রমান্বয়ে ভরাট হতে চলেছে। জলজ প্রাণী বিশেষ করে কয়েক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গঙ্গার ডলফিন ও ঘড়িয়াল আর দেখা যায় না। আগের মতো পদ্মায় ইলিশের ঝাঁক আর আসে না। মহাবিপর্যয়কর অবস্থায় গঙ্গা অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র। নদীকেন্দ্রীক নানা ধরনের পেশা হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়। এক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশের গঙ্গায় আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এখনও বলবৎ। চুক্তি অনুযায়ী প্রকৃতই বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে কিনা এবং কতটুকু পানি পাচ্ছে সেটি জনগণ অবহিত নয়। ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার পূর্বেই শক্তিশালী কমিটির দ্বারা এর মূল্যায়ন করতে হবে। নতুন চুক্তির জন্য হালনাগাদ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে হোম ওয়ার্ক সম্পন্ন পূর্বক পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরী। নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের চুক্তির অনরুপ গ্যারান্টিক্লস অবশ্যই অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। যৌথ নদী কমিশনে নেপালকে অন্তর্ভূক্ত করে বৈঠক করতে হবে বলেও দাবি করেন এই নদী গবেষক। #