মো. শরিফুল ইসলাম:
বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপিকা জিনাতুন নেসা তালুকদার(জন্ম ৯ জুলাই ১৯৪৭)। পিতা: মরহুম পারভেজ আলী মিয়া, মাতা; মরহুম জহুরা খাতুন। দুই ভাই, চার বোন। তিনি সরকারি পিএন বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে প্রথম অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। জিনাতুন নেসা তালুকদারকে ১৯৬৪ সালে ৯ জানুয়ারী বিবাহ হলে পড়াশুনায় একটু ছন্দপতন ঘটে। স্বামীর অনুপ্রেরণায় ১৯৬৬ সালে রাজশাহী সিটি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়ে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী সরকারী কলেজে ইতিহাসে স্নাতক(সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে জিনাতুন নেসা তালুকদার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ৩য় বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক(সম্মান) সম্পন্ন করেন এবং যুদ্ধের পরে ১৯৭৪ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৮৫ সালে এল.এল.বি করে এডভোকেটশীপ করেন।
১৯৬৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারীতে ড. শামসুজোহা স্যারকে পাক আর্মিরা হত্যা পর রাজশাহীতে জিনাতুন নেসা তালুকদার স্বামী নিয়ে আন্দোলন, মিছিল, সভা, সমাবেশ করেছেন।
জিনাতুন নেসা তালুকদার ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এএইচএম কামারুজ্জামান(হেনা) এর কলেজিয়েট স্কুলে পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই নির্বাচনে আরোও দলের যাদের সাথে কাজ করেছিলেন তারা হলেন মাতবর হোসেন চাচার স্ত্রী নুরজাহান, সাংবাদিক হিসাম উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী আসমা আহমেদ, কহিন প্রেসের মালিকের বড় বোন জাহানারা হক।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশে আন্দোলন শুরু হলে জিনাতুন নেসা তালুকদার এবং তাঁর স্মামী রাজশাহীর আন্দোলনে সর্বক্ষণ মাঠে ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর দায়িত্বে প্রথম মহিলা ক্যাম্প(ক্যাম্পের রেসিডেনসিয়াল ডিরেক্টর) করা হয়েছিল, নাটোরের ছয় ফুট লম্বা বিভা রানী সরকার (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার বিভাগের ছাত্রী ছিলেন) সহ আরোও কয়েকজন মহিলা ছিল। সেই মহিলা ক্যাম্পে জিনাতুন নেসা তালুকদার প্রথম ব্যাচে ট্রের্নিং গ্রহণ করেছিলেন। ক্যাম্পটি ৮ নম্বর মহেন্দ্র রায় লেন, গোবরা মোল্লাপাড়ায় অবস্থিত ছিল। প্রথম ব্যাচে ২০০ জন মেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। বিএআরসি(বাংলাদেশ কলকাতা রেলওয়ে) হাসপাতালে প্রথম ব্যাচে নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছিল ২০ জন। তাদের মধ্যে জিনাতুন নেসা ছিলেন। যশোরের মেয়ে আম্বিয়া(ডাক্তারের মেয়ে), পাবনার শিরিন বানু মিতিল(টেলিভিশনে টিএন্ডটি দখল করা দেখায়) নার্সিং প্রশিক্ষণে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যান্ডেজ, স্যালাইন ও তিন প্রকারের ইনজেকশন দেওয়া শেখানো হয়েছিল। এরপর তাদের ২০ জনকে দুই দিন, দুই দিন করে মেডিসিন ও সার্জিারিতে ২০ দিন প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। নার্সিং প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে তাঁদের ক্যাম্পে নেওয়া হয়। জিনাতুন নেসা তালুকদারকে ৭ নং সেক্টরের মেজর কাজী নুরুজ্জামানের অধীনে ৪ নং সাব-সেক্টরে যুক্ত ছিলেন। তিনি ৪ নং সা-সেক্টরের অধীনে যুদ্ধাহত এবং অন্যান্য সাধারণ শরণার্থীদেরও সেবা করতে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধে কোন অপারেশন করতে পারেননি।
১৯৭১ সালে ২৫ ডিসেম্বর সোনা মসজিদ দিয়ে জিনাতুন নেসা তালুকদার এবং তার স্বামী আব্দুল্লাহিল বাকী দেশে এসেছিলেন। ২৬ ডিসেম্বর সার্কিট হাউজে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। যুদ্ধের পর বীরাঙ্গনাদের সহযোগিতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী বিধবাদের বঙ্গবন্ধু ২০০০ টাকা করে অনুদান দিয়েছিলেন। রাজশাহী মহকুমার কারণে শহীদ বিধবা স্ত্রীদের অনুদানের টাকা এসডিও জিনাতুন নেসার কাছে হস্তান্তর করতেন। পাশাপাশি নারী পুর্ণবাসন বোর্ডের সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন এবং নির্যাতিত নারীদের খোঁজে বের করে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করতেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নরওয়ে রেড ক্রস ঔষুধ, কম্বল, দুধ, ঘি সহ অন্যান্য জিনিস দিয়ে সাহায্য করত। তাহেরপুর, কাটাখালী, দুর্গাপুর, পারিলা, বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন জায়গায় এই টিমের সাথে জিনাতুন নেসা কাজ করেছিলেন।
১৯৭২ সালে শ্রদ্ধেয় এএইচএম কামারুজ্জামান হেনা সাহেব আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সংগঠনকে গোছানোর জন্য জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দায়িত্বে জিনাতুন নেসা তালুকদারকে দেওয়া হয়েছিল। পরে ১৯৭৬ সালে রাজশাহী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং ১৯৯৬ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। (২০০৪-২০০৭) ও (২০১৫-২০১৭) মেয়াদে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। (২০১৯-২০২২) মেয়াদে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনেরও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সহ স্বপরিবারের হত্যার পর রাজশাহীতে হাতে গোনা কয়েকজন প্রকাশ্যে মাঠে ছিলেন। তাদের মধ্যে তিনি একজন। জিনাতুন নেসা তালুকদার এবং স্বামী আব্দুল্লাহিল বাকীকে বিএনপিতে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ সত্ত্বেও নিতে পারেনি। আবার জাতীয় পার্টিতে নেওয়ার জন্য এনএসআই এর একজন কর্মকর্তা এবং গোর বাবুর ছেলে এ্যাড. অংকুর সেন একপ্রকার বল প্রয়োগ করেন, রাজি না হওয়ায় প্রশাসনের মাধ্যমে হেনস্তা ও ভয়ভীতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নারী বঙ্গবন্ধুকে এতো শ্রদ্ধা এবং সম্মান করতেন, আদর্শ মেনে চলতেন যে কেউ ক্ষমতার লোভ ও ভয়ভীতি দেখিয়েও বঙ্গবন্ধুর আর্দশচ্যুত করতে পারেনি।
১৯৭২ সালে এএইচএম কামারুজ্জামান হেনা সাহেব নওহাটায় কলেজ প্রতিষ্ঠার সদস্যদের মধ্যে তিনি ছিলেন। নওহাটা কলেজ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এএইচএম কামারুজ্জামান হেনা সাহেবের সাথে জিনাতুন নেসা তালুকদার সহ আব্দুল হাদি, জাফর, আশরাফ দেওয়ানরা ছিলেন। পরে ১৯৭৭ সালের ১ জুন জিনাতুন নেসা তালুকদার নওহাটা কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক পদের নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালের ৫ জুলাই সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে সাক্ষাতকার এবং রাত ১২ ঘটিকায় তালিকা প্রকাশ। পরের দিন শপথ। ১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এবং ১৯৯৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ। ১৯৯৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রথম প্রতিমন্ত্রী এবং পূর্ণ ক্যাবিনেট প্রতিমন্ত্রী। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছিলেন।
অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। সকল মানুষদের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। রাগ-অভিমান করতে কখনই দেখি নাই। চলাচল ছিল অতি সাধারণ। দলের কর্মীদৈর খুব ভালবাসতেন, প্রবীণদের সম্মান করতেন। এই বয়সেও দলের যেকোন সভা, সমাবেশে সরব উপস্থিতি ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দেশের উন্নয়নমূলক কাজের সবসময় প্রসংশা করতেন এবং বলতেন তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের সাধারণ মানুষের জন্য যেটা ভাল হবে তা করতেন। দেশের উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখনই একধাপও পিছপা হবেন না। কারণ তার সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা। তিনি বলেন, আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম তখন যে কোন সমস্যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় পাশে থেকে সহযোগিতা, পরামর্শ ও সাহস যুগিয়েছেন। তিনি বলতেন দলের কর্মী হল সংগঠনের প্রাণ। আমার দরজা সকলের জন্য সবসময় খোলা থাকে। তিনি একজন উদার, নিরহকারী, মিষ্ঠভাষী, সদালপী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।
মো. শরিফুল ইসলাম, প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, শাহ্ মখদুম কলেজ, রাজশাহী