রাজশাহী সংবাদ ডেস্ক
বাংলাদেশের পুলিশ বলছে, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে দুই-তিন মাস আগে থেকেই খুনের পরিকল্পনা করেছিল অপরাধীরা। রাজধানী ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি বাসায় একাধিক বৈঠকে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলেও তারা জানান। এদিকে এই হত্যার তদন্তে নেমে কলকাতায় একজন দুষ্কৃতীকেও আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি জানিয়েছে। পাশাপাশি সেখানে দুটি গাড়ি আটক করা হয়েছে। খবর: বিবিবিসি বাংলা
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ আজ দুপুরে মিন্টো রোডে তার কার্যালয়ে এই হত্যাকান্ড নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। মি. রশীদ সংবাদ সম্মেলনে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা কোথায়, কখন, কীভাবে ও কারা সংঘটিত করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
তিনি জানান, এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান বা শাহীন। শাহীন এমপি আজীমের বাল্যবন্ধু। তার সাথে ব্যবসায়িক বিরোধ কী ছিল, সে বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান মি. রশীদ।
“২৫ এপ্রিল জিহাদ অথবা জাহিদ এবং সিয়াম কলকাতার সঞ্জীভা গার্ডেনে বাসা ভাড়া করে। এজন্য ৩০ এপ্রিল ঘটনার মাস্টারমাইন্ড কলকাতায় যায়”, বলেন মি. রশীদ।
“হত্যাকান্ড সংঘটিত করবেন উনি ও আরেকজন। সাথে ছিলেন তাদেরই গার্লফ্রেন্ড। তিনজনে মিলে ৩০ এপ্রিল বিমানযোগে কলকাতা চলে যায়। যে বাসা ভাড়া করা হয় সেখানে তারা উঠে। বোঝাতে চায় এখানে পরিবার থাকবে। অপরাধের কোনও কিছু ঘটবে না।”
ঘটনার পূর্ব পরিকল্পনা কীভাবে হয়েছে, তা বর্ণনা করতে গিয়ে মি. রশীদ বলেন, “তারা দুইমাস যাবত এটাও খেয়াল করছিল ভিকটিম কবে আসা যাওয়া করে। কলকাতা কখন যায়। কারণ তিনি মাঝেমধ্যে কলকাতা যান। এবার ১২ই মে সেখানে যান ও বন্ধু গোপালের বাসায় উঠেন। এখান থেকে তারাও সেখানে যায়। আরও দুইজনকে সেখানে ভাড়া করে।”
“কলকাতার এই বাসাতে আসা যাওয়া করবে, এমন দুজনকে ঠিক করে। মাস্টারমাইন্ড সেখানে সব কিছু ঠিক করে, কোন গাড়ি ইউজ হবে, কাকে কত টাকা দিতে হবে। কারা কারা থাকবে সেগুলো সব কিছু ঠিক করে অপরাধ সংঘটিত করতে পাঁচ- ছয়জনকে রেখে ১০ই মে দেশে চলে আসে” বলেন মি. রশীদ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এমপি আজীম কলকাতায় ১২ই মে গিয়ে বন্ধু গোপালের বাসায় ছিলেন। পরদিন হত্যাকাণ্ড যারা ঘটায় তাদের সাথে যোগাযোগ হয় তার।
মি. রশীদ বলেন, “১৩ই মে উনার ওই চক্রটার সাথে কথা হয়। প্রথমে ফয়সাল নামের একটা ব্যক্তি সাদা গাড়িতে রিসিভ করে”।
“সেখান থেকে নিয়ে কিছু দূরে যে মূল হত্যাকাণ্ডটা সংঘটিত করে সে, ফয়সাল ও ইনডিয়ান ড্রাইভার ছিল রাজা। সে (রাজা) আসলে কিছুই জানে না, সে ছিল ক্যারিয়ার। সে তাদেরকে নিয়ে ওই বাসায় যায়। ওই বাসায় যাওয়ার পরই মোস্তাফিজ নামে আরেকজন ঢুকে। জিহাদ ও সিয়াম আগেই ওই বাসায় ছিল।”
“আধাঘন্টার মধ্যেই এই নৃশংস হত্যা সংঘটিত করেছে। এর আধা ঘন্টা বা একঘন্টা পরে এদের একজন বাইরে যায়। সেখানে ভিকটিমের মোবাইল অন করে কথাবার্তা বলে, অর্থাৎ ডিভাইসটাকে ভিন্ন খাতে নিতে চায়।”
কেউ যাতে এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে না পারে এবং লাশ খুঁজে না পায় সে পরিকল্পনা অনুযায়ী অপরাধীরা কাজ করেছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
এ কারণে এমপি আজীমের লাশ বিভিন্ন ভাগে ভাগে সরানো হয় নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাট থেকে।
মি. রশীদ বলেন, “তাদের প্ল্যান ছিল বিদেশের মাটিতে হত্যাকান্ড সংঘটিত করবে। এবং লাশটাকে এমনভাবে গুম করবে যাতে কেউ কোনও দিন খুঁজে না পায়।”
“যার কারণে বিভিন্ন পার্টে ভাগ করে ফেলেছে। হাড্ডির সাথে মাংস আলাদা করে ফেলছে। এবং সেটাকে গ্রে কালারের সুটকেসে করে মূল আমাদের কাছে যিনি আছেন উনি আর জাহিদ এরা দুইজন বেরিয়ে যান। পাবলিক টয়লেটের কাছে একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিল।”
মি. রশীদ জানান, “ওইখানে সিয়াম আর জাহিদ চলে যায়। আমানুল্লাহ চলে আসে। মূল হত্যাকারী বাসায় চলে আসে। পরের দিন উনি ও আরও তিনজন বাকি মাংসগুলোকে বিভিন্ন পলিথিনে করে নিয়ে বের করে নিয়ে যায়। এভাবে যে মাংস নিচ্ছে, পথে যদি কেউ ধরে এজন্য হলুদের মসলা দিয়ে নিয়েছে। যদি কেউ ধরে বলবে বাজার থেকে মসলা দেয়া খাবার উপযোগী মাংস নিচ্ছি!”
“অপরাধীদের উদ্দেশ্য ছিল এমনভাবেই গুম করা হবে তাতে যেন কেউ কোনও দিন তার অস্তিত্ব না পায়”, জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মি. রশীদ।
এমন কী ঘটনা ঘটানোর পর অপরাধীরা পরিকল্পনা অনুযায়ী একে একে বাংলাদেশে চলে আসে। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর বিভিন্ন দিনে অপরাধীরা দেশে ফিরে আসে বলে জানানো হয়।
“এভাবে পর্যায়ক্রমে ওরা যখন একে একে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে , ঠিক তখনই মাস্টারমাইন্ড যে ১০ই মে চলে আসছিল, সে তখন ভিস্তারা এয়ারলাইনসে দিল্লি যায়। সেখান থেকে দুই ঘন্টা ট্রানজিট নিয়ে কাঠমান্ডু হয়ে হয়তো অন্য কোথাও চলে যেতে পারে”, বলেন মি. রশীদ।
এমন কী অপরাধ তদন্তকারী সংস্থা যাতে এ হত্যাকাণ্ডের কোনও কিনারা খুঁজে না পায়, তাই এমপি আজীমের মোবাইল ফোন থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসএমএস বা ফোনও করা হত। একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা।
“টোটাল উদ্দেশ্য ছিল একদিকে লাশ গুম করা, অস্তিত্ব যেন কখনও না পাওয়া যায়। অন্য দিকে তদন্তকারীরা যেন কোনও ডিভাইস খুঁজে না পায়। আবার ইনডিয়ান পুলিশের নজর যেন বাংলাদেশে না আসে”, বলেন মি. রশীদ।
গ্রেফতারকৃত তিনজন হত্যার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে বলেও জানান মি. রশীদ।
তিনি বলেন, “যেসব আসামিরা আছে তাদের কাছ থেকে আদি-অন্ত সব জেনেছি। তারা স্বীকার করেছে। কলকাতার ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ, কলকাতার পুলিশ সকলের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। ওরাও গাড়ি আর কিছু কিছু জিনিস উদ্ধার করেছে।”
কলকাতা পুলিশের দুজন কর্মকর্তারও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
এমন কী, প্রয়োজন হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বাংলাদেশ থেকেও পুলিশ যাবে বলে জানান তিনি।
মি. রশীদ জানান, “যে ফ্ল্যাটে খুন করা হয়েছে সেখানে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে বলেই কলকাতা পুলিশ মামলা করেছে। পুরো মরদেহ উদ্ধার করতে না পারলেও খন্ডিত অংশ উদ্ধার করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের মাটিতে অপরাধ করার সাহস পায়নি। তাদের যে পরিকল্পিত প্ল্যান … তাদের গুলশান ও বসুন্ধরার যে দুই বাসায় অন্তত এক-দুইমাসে অনেকগুলি প্ল্যান তাদের হয়েছে”।
“বারবারই তারা ঠিক করে বাংলাদেশে তারা করবে না। এখানে হলে তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। তারা ভিকটিমের খোঁজখবর নিয়েই কলকাতায় গিয়েছে”, বলেন মি. রশীদ।
এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিলার আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও ‘গলাকাটা দলে’র মূল হোতা বলেও জানান মি. রশীদ।
এদিকে এই হত্যার তদন্তে নেমে কলকাতায় পুলিশ যে দুটি গাড়ি আটক করেছে, তার মধ্যে একটি গাড়িতে খুন হওয়ার আগে মি. আজীমকে চাপতে দেখা গেছে সিসিটিভি ফুটেজে।
অন্য গাড়িটিতে করে খুনের পরে আততায়ীরা বেরিয়ে গিয়েছিল বলে পুলিশের সূত্রগুলি জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার যে দুষ্কৃতীকে কলকাতায় জেরা করা হচ্ছে, তার নাম জুবেইর ওরফে জিহাদ। এখনও তাকে গ্রেফতার করা হয় নি।
অন্য দিকে কলকাতা থেকে সিআইডির তিনজন তদন্তকারী অফিসার ঢাকায় গিয়ে ডিবি প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বৃহস্পতিবার। তদন্তে যে সব নথি ও তথ্য প্রমাণ সিআইডি যোগাড় করতে পেরেছে, সে সবও নিয়ে গেছেন তারা।
আটক জুবেইর বাংলাদেশের নাগরিক বলেও সিআইডির সূত্রগুলি জানিয়েছে। এবং ওই সূত্রগুলি এটাও নিশ্চিত করেছে, যে সাতজনের নামে এফআইআর হয়েছে, এই জুবেইর ওরফে জিহাদের নামও তার মধ্যে আছে।
জিহাদ ছাড়া অন্য যাদের নাম এফআইআরে রয়েছে তারা হলেন আখতারুজাম্মান, আমানুল্লাহ, সিয়াম, মুস্তাফিজুর, ফয়সাল এবং শিলস্তি রহমান। এদের তিনজনকে ঢাকায় আটক করা হয়েছিল বুধবারই।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, যে আবাসিক কমপ্লেক্সে খুন হয়েছে সেখানকার সিসিটিভি দেখে তারা নিশ্চিত যে অভিযুক্তরা বড় বড় ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিলেন। এরা যখন কমপ্লেক্সে প্রবেশ করেন, তখন ওই ব্যাগগুলি তাদের সঙ্গে ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের নথি দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া
ভারতে বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হলে মালিক এবং ভাড়াটিয়া, আর যে দালালের মাধ্যমে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, সব পক্ষের ছবি সহ নথি স্থানীয় থানায় জমা দিতে হয়।
মুহম্মদ আখতারুজ্জামান, আমানুল্লা সৈয়দ এবং সেলেস্তি রহমান ওই ফ্ল্যাটে থাকবেন বলে সেটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল।
মে মাসের এক তারিখে নিউ টাউন থানায় এই নথি জমা করা হয়।
তার আগেই গোটা দল কলকাতায় চলে এসেছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
তিনজন থাকবেন বলে থানায় জমা দেওয়া নথিতে লেখা থাকলেও ফ্ল্যাটটি সল্ট লেক অঞ্চলের এক দালালের মাধ্যমে ভাড়া নিয়েছিলেন মুহম্মদ আখতারুজ্জামানই।
ভাড়া নেওয়ার সময়ে নথি হিসাবে তিনি নিউ ইয়র্কের ড্রাইভিং লাইসেন্সের নম্বরও জমা দিয়েছিলেন। রয়েছে তার ছবিও।
পেশা হিসাবে তিনি সেখানে লিখেছেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।
সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী জানিয়েছেন, “ওই ফ্ল্যাটটি সন্দীপ রায় নামের পশ্চিমবঙ্গের শুল্ক বিভাগের এক অফিসারের।“
‘আখতারুজ্জামানকে চিনি না’
যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়েছিল বলে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি জানিয়েছে, সেই ফ্ল্যাটটি মে মাসের গোড়ায় ভাড়া নিয়েছিলেন মি. আজীমের বন্ধু ও ব্যবসার সঙ্গী, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান, সেটাও বলেছেন সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী।
তবে মি. আজীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও আখতারুজ্জামানকে চেনেন না বলে দাবি করেছেন কলকাতার গয়না ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস।
সঞ্জীবা গার্ডেন্সের সদর ফটকে লাগানো সিসিটিভির ফুটেজ থেকেই হত্যার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে
ছবির ক্যাপশান,সঞ্জীভা গার্ডেন্সের সদর ফটকে লাগানো সিসিটিভির ফুটেজ থেকেই হত্যার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে
তিনি বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলাকে বলেন যে তার সঙ্গে নিহত সংসদ সদস্যের প্রায় আড়াই দশকের ঘনিষ্ঠতা হলেও আখতারুজ্জামান বলে কারও কথা তিনি শোনেননি।
“আমি আসলে তার ব্যবসা বা রাজনীতির জগতের পরিচিতদের চিনতাম না, এসব ব্যাপারে তার সঙ্গে আমার কথাও হত না”, বলেছেন মি. বিশ্বাস।
বুধবার সকালে বন্ধুর খুন হওয়ার খবর পাওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই কারও সঙ্গে কথা বলেননি তিনি, বাড়িতে ছিলেনও না।
বৃহস্পতিবারও তিনি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোনও জায়গায় আছেন।
তিনি বলছিলেন, “আমি যেহেতু মি. আজীমের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ডায়েরি করেছিলাম থানায়, তাই তিনি খুন হওয়ার পরে পুলিশ আমাকে নিউ টাউন থানায় গিয়ে খুনের মামলার ডায়েরি করতে বলেছিল।”
“তবে আমি অনলাইনে সেই ডায়েরি করেছি বরাহনগর থানা আর ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে,” জানিয়েছেন গোপাল বিশ্বাস।
তার দায়ের করা ডায়রির ভিত্তিতেই পুলিশ স্বতঃ:প্রণোদিত খুনের মামলা রুজু করেছে।