পাকিস্তানের ক্রিকেট মানেই অবিশ্বাস্য আর অপ্রত্যাশিত কিছু। যে দলকে কখনও সমীকরণে রাখা যায় না। আবার যাদেরকে কখনোই ছিটকে ফেলা চলে না। লম্বা সময় ধরে এভাবেই চলছে ম্যান ইন গ্রিনদের ক্রিকেট। অস্থিরতা, চমক আর অনিশ্চয়তার এই খেলায় পাকিস্তান সবাইকে বিষ্মিত করেছে বারবার। বরাবরই আলোচনা থেকে খানিক পিছিয়ে থাকা দলটাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে ধারাবাহিক দল।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপে রানারআপ, ২০০৯ সালে চ্যাম্পিয়ন। সেই দুইবারের পর আরও চারবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে গিয়েছে দলটা। সবমিলিয়ে ৮ আসরের মাঝে ৬ বারেই ছিল ম্যান ইন গ্রিনরা। তারপরেও এবার তারা নেই আলোচনায়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বর্তমান রানারআপ দলটা আছে বিচিত্র এক জটিলতায়। যে জটিলতা হয়ত তাদের থাকতে দিচ্ছে না ফেবারিটের তালিকাতে।
পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি সমস্যাটি বেশ বিচিত্র। একটা চক্রাকারে চলতে থাকা এক সমস্যা তাদের। আর সেটা ব্যাটিং লাইনআপকে কেন্দ্র করে। বোলিং লাইনআপে মোহাম্মদ আমির, শাহিন আফ্রিদি, হারিস রউফ আর নাসিম শাহ যেকোনো দলের জন্য আতঙ্কের নাম। তবে প্রসঙ্গ যখন ব্যাটিং ইউনিট, পাকিস্তান তখন বড্ড নড়বড়ে। দলে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা দশে থাকা দুই তারকা বাবর আজম এবং মোহাম্মদ রিজওয়ান থাকার পরেও ভুগতে হচ্ছে ২০০৯ আসরের চ্যাম্পিয়নদের।
অবশ্য সমস্যার বড় একটা অংশ মূলত এই দুজনেই। সাইম আইয়ুবের টানা ব্যর্থতা আবারও ওপেনার জুটিতে ফিরিয়ে এনেছে এই দুজনকে। গতকাল বৃহস্পতিবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সবশেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে দেখা গিয়েছে বাবর-রিজওয়ান জুটি। যদিও কাল দুজনে মিলে রান তুলেছেন ওভারপ্রতি ১০ এর কাছাকাছি।
কিন্তু রিজ-বার জুটি যে ধীরগতির ব্যাটিংয়ের জন্য সমালোচিত সেটা প্রায় সকলেরই জানা। বিশ্বকাপে দুজনের পরিসংখ্যান দেখলেই তা স্পষ্ট। রিজওয়ান বিশ্বমঞ্চে ব্যাট করেছেন ১২০ স্ট্রাইকরেটে। আর বাবরের বেলায় সেটা হয়েছে ১১৫ এর কম। সারাবিশ্বের বাকি ব্যাটারদের তুলনায় দুজনেই যে অনেকটা পিছিয়ে তা নতুন করে বলার কিছু নেই।
এবার আসা যাক মিডল অর্ডারে। পাকিস্তানের ফিনিশিং রোলে যাদেরই থাকার কথা, তারা প্রত্যেকেই ভয়াবহ ব্যর্থ। শাদাব খান নিজের ক্যারিয়ারের গতিই যেন হারিয়ে ফেলেছেন বিগত দুই বছরে। ব্যাট হাতে তাকে চিরচেনা বিধ্বংসী রূপে দেখা যায়নি অনেকটা দিন ধরে।
উইকেটরক্ষক-ব্যাটার আজম খান ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটে মারকুটে ব্যাট করে আলোচনায় এসেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের জার্সি এলেই যেন বিবর্ণ তিনি। এখন পর্যন্ত জাতীয় দলে নিজেকে মেলে ধরতেই পারেননি। এর আগে তিনি অভিযোগ করেছিলেন পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়াকে কেন্দ্র করে। এবার অবশ্য সুযোগ পেয়েও নিজের ক্ষমতা দেখাতে পারেননি এই ব্যাটার।
পাকিস্তানের ফিনিশিং পুরোটা যেন নির্ভর করছে ইফতেখার আহমেদের ওপর। তিনি ব্যর্থ হলে চাপ পড়ছে ইমাদ ওয়াসিম কিংবা শাহিন আফ্রিদির ওপর। কিন্তু স্বীকৃত ব্যাটারদের ব্যর্থতা দলের ওপর চাপ ফেলবে সেটা নিশ্চিতই।
ওপেনাররা বেশি বল খেলছেন। তাতে মিডল অর্ডারের জন্য পার্থক্য গড়ে দেয়ার মতো সুযোগ নেই। আর মিডল অর্ডারে শাদাব-আজম খানদের ব্যর্থতা কিংবা সাইম আইয়ুবের ফর্মহীনতা বাবর-রিজওয়ানকেই পাঠাচ্ছে ওপেনার স্লটে। এ যেন পাকিস্তান ক্রিকেটে সমস্যার এক চক্র।
রিজ-বার জুটি যে ধীরগতির ব্যাটিংয়ের জন্য সমালোচিত সেটা প্রায় সকলেরই জানা। বিশ্বকাপে দুজনের পরিসংখ্যান দেখলেই তা স্পষ্ট। রিজওয়ান বিশ্বমঞ্চে ব্যাট করেছেন ১২০ স্ট্রাইকরেটে। আর বাবরের বেলায় সেটা হয়েছে ১১৫ এর কম।
অথচ এই বাবর-রিজওয়ান জুটিতে ভরসা রাখার পেছনেও যুক্তি আছে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে রানের হিসাবে সবচেয়ে সফল জুটি বাবর-রিজওয়ানের। এখন পর্যন্ত যে জুটিতে উঠেছে ২৪৫৯ রান। আর কোনো ওপেনিং জুটির ২ হাজার রানই নেই। এই দুজনের কাছ থেকে ৮ বার ১০০ পেরুনো জুটি পেয়েছে পাকিস্তান। অন্য কোনো জুটি থেকে ৪ বারের বেশি শতরান আসেনি। রান উঠেছে ৪৯ এর বেশি গড়ে। এমন পরীক্ষিত জুটি থেকে মুখ ফেরানোও যেন দায়। কিন্তু ৭.৯৮ ওভারপ্রতি রান যে পাকিস্তানের দুশ্চিন্তার বড় কারণ।
কে খেলবেন পাকিস্তানের বিশ্বকাপের একাদশে। আজম খান নাকি মোহাম্মদ রিজওয়ান। এটা খুবই প্রত্যাশিত রিজওয়ান উইকেটের পেছনে দাঁড়াবেন। আর ফিনিশার রোলে থাকবেন আজম খান। কিন্তু জাতীয় দলে আজম খানের ব্যর্থতার পরিসংখ্যান সবারই জানা। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আর জাতীয় দলে যে অনেক বড় ব্যবধান আছে, সেটার উদাহরণ তিনি নিজেই।
আজম খান যদি না থাকেন, তবে ফিনিশার রোলের জন্য ভরসা সেই চূড়ান্ত অফফর্মে থাকা শাদাব কিংবা ধারাবাহিকতার অভাবে ভোগা ইফতিখার। শাহিন আফ্রিদি ব্যাট চালাতে পারেন বটে, তবে সেই ঝলক রোজ রোজ দেখতে পাওয়াটাও বিরল।
শেষ পর্যন্ত ডার্ক হর্স হিসেবেই কি না আবার বিদায় নিতে হয় পাকিস্তানকে। সেক্ষেত্রে বিশ্বকাপের পর পিসিবি আর পাকিস্তান ক্রিকেট নিয়ে নতুন কোনো নাটক দেখা গেলেও খুব একটা অবাক নিশ্চয়ই হবে না ক্রিকেট দুনিয়া।