বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তৃতীয় শক্তি ও তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি ছিল ব্রাদার্স ইউনিয়নের। সত্তর-আশির দশকের সেই ব্রাদার্স এখন অস্তিত্বের সংকটে। তিন বছরের মধ্যে দুই বার প্রিমিয়ার লিগের ফুটবল থেকে অবনমিত হয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ব্রাদার্স ইউনিয়ন তৃতীয়, দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবলে উঠে। উদ্বোধনী ম্যাচেই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ঢাকা আবাহনীকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করেছিল। ১৯৮০ সালে প্রথম ফেডারেশন কাপের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন, ১৯৮১ সালে আগাখান গোল্ডকাপে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ক্লাবের সঙ্গে যৌথ শিরোপা সহ আরো অনেক ঘরোয়া-আন্তর্জাতিক অর্জন আছে ক্লাবটির। ২০০৭ সাল থেকে খুড়িয়ে চলা ব্রাদার্স ২০২১ সালে ৪৬ বছর পর শীর্ষ স্তরের ফুটবল থেকে অবনমিত হয়। পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলেনি। ২০২২-২৩ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আবার প্রিমিয়ার ফিরেছিল ব্রাদার্স। চলতি মৌসুমে প্রিমিয়ার খেললেও স্থায়ী হতে পারেনি। এক ম্যাচ আগে থাকতেই অবনমিত। ১৭ ম্যাচে জয় মাত্র একটি, ড্র চারটি আর পরাজয় ১২। ১৭ ম্যাচে ব্রাদার্স গোল হজম করেছে ৬৪ ফলে গড়ে প্রায় চারটি।
ব্রাদার্সের ফুটবল দলের এই উঠা-নামার দায়ভার সম্পূর্ণ নিজের কাধে নিয়ে ক্লাবটির ডিরেক্টর ইনচার্জ মহিউদ্দিন আহমেদ মহী পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘ফুটবল অবনমনের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে ডিরেক্টর ইনচার্জ হিসেবে পদত্যাগ করছি। পদত্যাগপত্র প্রস্তুত আজ-কালের মধ্যে সভাপতি (নজরুল ইসলাম) ও গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানকে (আজম নাসির) প্রেরণ করব।’ গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান আজম নাসির ক্রিকেট দল দেখভাল করেন। ফলে ক্রিকেট নিয়ে তেমন ভাবনা থাকে না। গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান দিলেও ক্লাব সভাপতির কাছ থেকে তেমন সহায়তা আসে না বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্ট অনেকের। এতে ফুটবলে দুরবস্থা আরো বাড়ে। ব্রাদার্স ইউনিয়নের ফুটবল দল মূলত দেখাশোনা করেন ক্লাবের পরিচালক ও ম্যানেজার আমের খান। মহীর মতো তিনিও সরে যেতে চান, ‘দুই-একজনের অমানুষিক পরিশ্রম দিয়ে প্রিমিয়ার লিগে দল চালানো যায় না। ভলান্টিয়ারি হিসেবে অনেক দিন করেছি। আর পারছি না। আমারও আর দায়িত্বে থাকার তেমন ইচ্ছে নেই। অন্য কেউ হাল ধরুক।’
২০১৬ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন লিমিটেড হলেও সেই ঘুরে ফিরে তিন-চার জনেই সীমাবদ্ধ ক্লাবটি। ফলে সকল ঝক্কি দুই তিন জনের উপরই যায়। মহী আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় তিনি ক্লাবে কয়েকজন নেতাকে পরিচালক করেছিলেন। সেই নেতারাও আর্থিকভাবে সহায়তা করেন না। ফলে সব দায়ভার পড়ে তার ওপরই।
ব্রাদার্স ক্লাব গত এক যুগ থেকেই আর্থিক ও সাংগঠনিক সংকটে রয়েছে। পুনরায় ফুটবলে অবনমন হওয়ার পর আরো সংকটের সময় ডিরেক্টর ইনচার্জ সরে দাড়ালে ক্লাবের ভবিষ্যত আরো অন্ধকার। ক্লাবের সামনের দিনগুলো সম্পর্কে মহীর বক্তব্য, ‘ফুটবলকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাখতে পারিনি এটা আমার ব্যর্থতা। তাই সরে যাচ্ছি। যারা ক্লাবকে ভালো পর্যায় বা উন্নতি করতে পারবে দায়িত্ব নেবে। ডিরেক্টর ইনচার্জ না থাকলেও ক্লাবের সঙ্গে ছিলাম, আছি থাকব।’
ব্যর্থতার দায়ে পদ ছাড়ার ঘটনা বাংলাদেশে বেশ বিরল, বিশেষত ক্রীড়াঙ্গনে। মহি ফুটবলে ব্যর্থতার জন্য দায়িত্ব ছাড়তে চাইলেও ব্রাদার্সকে ভিত ধরেই তিনি ফুটবল ফেডারেশন, বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের কর্মকর্তা হয়েছেন। ব্রাদার্সের উন্নয়ন করতে না পারলেও সংগঠক হিসেবে নিজের উন্নতি ঠিকই করেছেন এমন আলোচনা রয়েছে ক্রীড়াঙ্গনে। ১৯৮৬ সাল থেকে গোপীবাগের সন্তান হিসেবে মহী ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও গত এক দশকেই মূলত ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তিনি শীর্ষ পর্যায়ে বিচরণ করছেন। ব্রাদার্সের চরম সংকটের মধ্যেও তিনি সম্প্রতি ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি, ওয়ারী ক্লাবের সহ-সভাপতি হিসেবে পদে রয়েছেন। আগে ছিলেন শেখ রাসেল ক্লাবেরও পরিচালক। এত পদে থাকায় নানা সময় নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় ফলে তার মূল শেকড় ব্রাদার্স ইউনিয়নে মনোযোগ কতটুকু তা নিয়ে ঘোরতর প্রশ্ন উঠে প্রায়ই।
ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব পেশাদার ফুটবলের শুরু থেকেই রেলিগেশন লড়াইয়ে। কয়েক দফা অবনমন এড়াতে পারলেও তিন বছরের মধ্যে দুই বার ব্যর্থ হয়েছে। ব্রাদার্স ইউনিয়ন যে মানের দল গড়ে সেই একই মানের দল গড়ে রহমতগঞ্জ, চট্টগ্রাম আবাহনী প্রিমিয়ার লিগ খেলছে। ঐ ক্লাবগুলো পারলে ব্রাদার্স পারছে না কেন? এই প্রসঙ্গে মহীর ব্যাখ্যা, ‘রহমতগঞ্জের স্থানীয় ব্যক্তিরা সহায়তা করে। চট্টগ্রাম আবাহনীতেও পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। ব্রাদার্স ইউনিয়নে আর্থিক সংকট প্রকট। সাম্প্রতিক সময়ে বসুন্ধরা কিংস কিছুটা সহায়তা করেছে এছাড়া আমার এবং আমেরকে (ম্যানেজার) অর্থ জোগাড়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।’
ব্রাদার্স ইউনিয়নের ক্রিকেট দল নিয়েও প্রতি বছরই আলোচনা-সমালোচনা হয়। বিশেষ করে পারিশ্রমিক বকেয়া নিত্য দিনের ঘটনাই। এরপরও ব্রাদার্সের ক্রিকেট দল প্রিমিয়ারেই খেলছে। ক্রিকেটে পারলে ফুটবলে কেন পারছে না এই প্রসঙ্গে ক্রিকেট দলের ম্যানেজার ও ক্লাবের পরিচালক আমিন খান বলেন, ‘ক্রিকেটের লিগ দেড়-দুই মাসের। ফুটবল প্রায় বছর জুড়েই। ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলে অনেক ব্যয় প্রয়োজন। ক্রিকেটে আমাদের যারপরনাই চেষ্টা থাকে সমমানের দলগুলোর সঙ্গে জিততেই। সেই ম্যাচগুলো জিতে আমরা অবনমন এড়িয়ে যেতে পারছি।’
ক্রিকেট ম্যানেজার আমিন খানের আপন ভাই আমের খান ব্রাদার্স ইউনিয়নের ফুটবল ম্যানেজার। ক্লাবের পাশাপাশি তিনি জাতীয় ফুটবল দলেরও ম্যানেজার। ঘরোয়া ফুটবলে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই ম্যানেজার ফুটবল দলের ব্যর্থতা নিয়ে বলেন, ‘আমাদের দল মাঠে ভালো খেলতে পারছে না তাই বারবার এমন হচ্ছে। ভালো খেলতে হলে যে অর্থ ও লোকবল প্রয়োজন সেটা আমাদের নেই। এটা সত্য এবং বাস্তব কথা।’
ফুটবলে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আমের খান। ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য হয়েও ফুটবলের স্বার্থে কথা বলতে পিছপা হন না। অথচ তার ক্লাবেই রয়েছে অনেক উদাসীনতা। কয়েক মৌসুম আগে গোপীবাগ থেকে মতিঝিল বাফুফে ভবনে খেলোয়াড় নিবন্ধন ফরম জমা দিতে বিলম্ব হওয়ায় বিষয়টি ফিফা পর্যন্ত গড়িয়েছিল। গত পরশু দিন প্রিমিয়ার লিগের বয়স ভিত্তিক দলদলের শেষ দিনেও রেজিস্ট্রেশন করেনি ব্রাদার্স। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আরো দুই দিন সময় বাড়িয়েছে ফেডারেশন। রেজিস্ট্রেশন, কোচ, খেলোয়াড়সহ আনুষাঙ্গিক অনেক বিষয়ে পেশাদারিত্বের বড় অভাব ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির।
ব্রাদার্সের ফুটবল দল গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকেন গোপীবাগের সন্তান মহিদুর রহমান মিরাজ। যিনি ওয়ারী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। ব্রাদার্সের এই অবনমন প্রসঙ্গে তার পর্যবেক্ষণ, ‘এই মানের দল গড়ে অবনমন এড়ানো কঠিন তবে এই দল নিয়ে আরো ফাইট করা সম্ভব এজন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা। পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।’
মোহামেডানের দুঃসময়ে সাবেক তারকা ফুটবলাররা হাল ধরেছিলেন। ব্রাদার্সের অনেক কিংবদন্তী ফুটবলার রয়েছেন। তাদের কাউকে ক্লাবের থেকে ডাকা হলেও অভিমানে আসেন না, কেউ আসলেও সেভাবে সময় দেন না আবার অনেককে ডাকেও না ক্লাব।