কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় সারা দেশে যে কিয়ামত বয়ে গেছে তাতে যারা নিহত হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাদের পরিবারকে শোক সইবার শক্তি দিন। আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করছি। সেই সঙ্গে এসব হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
আমরা এক মারাত্মক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতার পর একমাত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের সময় দেশে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। আর এবার কোটাবিরোধী বা কোটা সংস্কার আন্দোলন তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপকতা অর্জন করেছে। প্রাণহানি হয়েছে অনেক। সম্পদ ধ্বংসের কোনো সীমাপরিসীমা নেই। সাধারণ ছাত্রদের দাবিদাওয়া নিয়ে প্রায় সব সময়ই আন্দোলন হয়, সংগ্রাম হয়। আবার কদিন পর সেটা মিটেও যায়। এবার কোটাবিরোধী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল হাই কোর্টের একটি রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ২০১৮ সালে কোটা বিলুপ্তির পর খুব সম্ভবত ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাই কোর্টে আপিল করেছিল। সে আপিলের ফলে গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় সারা দেশে কিয়ামতের আলামত চলছে। প্রথম প্রথম শুধু সাধারণ নিরীহ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে ছিল। সেটা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন ওভাবে ছড়িয়ে পড়ায় দোষের ছিল না। দোষের ছিল সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করা বা না করতে পারা। আমাদের দেশে পন্ডিতের অভাব নেই। একজন মানিক বলে পন্ডিত আছেন, তিনি কেমন মানিক? মানিক তো মহামূল্যবান ধাতু। কিন্তু তাকে তেমন মনে হয় না। তিনি কেমন যেন সব সময় নিম্নমানের কথা বলেন। ইংল্যান্ডে থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। সুলতান শরীফসহ ইংল্যান্ডের বহু নেতাকে জিজ্ঞেস করেছি তারা বারবার বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে কাগজ টোকানোর কাজেও মানিক ছিলেন না।’ সব সময় এমন নিম্নমানের কথা বলেন, লোকজন বলেন জনাব মানিকের কথা শুনলে তাদের নাকি গা জ্বলে। শুধু গা কেন, অনেকের পা-ও জ্বলে। তাকে টকশোয় বলতে শুনলাম, ‘ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ চেষ্টা করলে কয়েক মিনিটেই আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করতে পারে।’ সে রকম চেষ্টাও করা হয়েছে। হলে হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ খড়্গহস্ত হয়েছিল। কোনো কাজ হয়নি। বরং বুমেরাং হয়েছে। ঘটনাটি ঘটার আগে আমার কল্পনায়ও ছিল না স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রলীগ সভাপতির হলের ঘরদুয়ার ভাঙা যায়; সেটাও হয়েছে। আইয়ুব-মোনায়েম তার পেটোয়া বাহিনী এনএসএফ দিয়ে ষাটের দশকে আমাদের দমাতে পারেননি। আগে ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, এখন কিছুই নেই। সেটাই প্রমাণিত হলো এ কদিনের ঘটনায়। টাঙ্গাইলে আমি জন্মেছি, টাঙ্গাইলের ছাতিহাটিতে নিজের গ্রামে বাবা-মার কবরের পায়ের কাছে আমার কবর হবে এমনটাই আশা। টাঙ্গাইল স্বাধীন করে ১১ ডিসেম্বর ’৭১-এ মাগরিবের আগে আগে টাঙ্গাইল ভিক্টোরিয়া রোডে আওয়ামী লীগের অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। হানাদারকবলিত আওয়ামী লীগ অফিস অমন ক্ষতবিক্ষত দেখিনি, সেদিন কোটাবিরোধী আন্দোলনে যতটা ধ্বংস হয়েছে। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছে, ছাত্রদের আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ঢুকে পড়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। বিরোধী দলের কাজ ফাঁকফোকর দিয়ে ঢোকা এবং সরকারকে অপ্রিয় করা। সে কাজ তারা করবে এবং তারা করেছে। সরকারের জন্য তখনই মঙ্গল যখন সেটা ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবে। তেমনটা হয়নি। কোনো কিছুই ভালোভাবে মোকাবিলা করা হয়নি বা যায়নি। যার পরিণতি বর্তমান অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা প্রথমে ভারত এবং তারপর চীন গিয়েছিলেন। ভারতে ১০ সমঝোতা, চীনে ২১টি। তার পরও নিন্দুকরা বলছিল ভারতের কাছে বাংলাদেশ বিক্রি করে দিয়েছে আর চীনের সঙ্গে ২১ সমঝোতা স্বাক্ষরের পরও কিছু পায়নি, চীন সফর ব্যর্থ হয়েছে। আমার কাছে কিন্তু তেমন মনে হয়নি। চীন সফর থেকে ফিরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভের সঙ্গে যা বলেছিলেন তার কথার অর্থ যা-ই থাকুক, অনেকাংশে ভুল প্রভাব পড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার কন্যা। তাঁর কথার মূল্য ও প্রভাব আমাদের সবার কথার থেকে আলাদা। ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কোটা পাবে না, তাদের নাতিপুতিরা পাবে না তবে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ কথা বলায় কাউকে রাজাকার-আলবদর বা স্বাধীনতাবিরোধী বলা হয় না।
হাই কোর্টের বারান্দায় বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে লেখক
তবু কথাটি অসাবধানতায় তাঁর মুখ থেকে ওইভাবে বেরোনোয় উল্টো অর্থ করা সম্ভব হয়েছে বা করা হয়েছে। তাতে অনেকেই খেপে গিয়ে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ বলেছে। এতে সত্যিই মর্মাহত হয়েছি, আঘাত পেয়েছি। আমাদের সন্তানরা তারা যে খুব আনন্দে নিজেদের রাজাকার রাজাকার বলেছে ব্যাপারটা তেমন নয়। তারাও নিদারুণ মর্মযাতনায় নিজেদের রাজাকার বলে আখ্যায়িত করেছে। ব্যাপারটা একেবারেই ভালো হয়নি। ১৯ জুলাই গ্রামের দিকে গিয়েছিলাম। বিখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামের বাড়ি কালিহাতীর চারান। রাস্তা বন্ধ করে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক গাড়ি ছিল। আমার গাড়ি কাছাকাছি যেতেই ১৫-২০ বছরের আট-দশটি ছেলে ছুটে এসে হাত ধরে। কেউ বলে, ‘কাকা, দাদা, মিয়াভাই, আমরা আন্দোলনে নাইমা পড়ছি। বড় ভাইদের মারতাছে। আমরা আর ঘরে বইসা থাকতে পারি নাই।’ আমার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল, সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটা গাড়ি। সন্ধ্যায় টাঙ্গাইল ফিরে কালিহাতীর সংসদ সদস্য লতিফ ভাইকে বলেছিলাম, কাল একটা প্রেস কনফারেন্স করতে চাই, আপনি থাকলে ভালো হয়। সদ্য কালিহাতী উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আজাদকেও থাকতে বলেছিলাম। সে রাত থেকেই দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে জানতাম না। তবু টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম একদিকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, আরেকদিকে ছোট ভাই আজাদ। যে বড় ভাই না হলে আমি রাজনীতিতে আসতাম না, বঙ্গবন্ধুকে পেতাম না, মুক্তিযোদ্ধা হতাম না। দুই ভাইয়ের মাঝখানে বসে বেশ স্বস্তি ও ভরসা পাচ্ছিলাম। প্রতি মুহূর্তে এখানে সেখানে দাঙ্গায় লোক মারা যাচ্ছিল। এমনকি নরসিংদীর জেল ভেঙে ৮২৬ জন পালিয়েছে। সঙ্গে কিছু অস্ত্রশস্ত্রও নিয়ে গেছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় জেল ভেঙে কেউ পালায়নি, আমরাই তালা খুলে দিয়েছিলাম। ঘটনাগুলো কেমন যেন অসহনীয় হতে চলেছে। তাই ২০ জুলাই টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবে এক পর্যায়ে বলেছিলাম, বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর আমেরিকায় দেওয়া বক্তব্য নিয়ে যে ভুল ব্যাখ্যা হয়েছিল আমি তার জন্য জাতীয় প্রেস ক্লাবে পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলাম। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেছেন। আজ তাঁকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় সম্মান দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, পিতা নিহত হলে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁর হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম, ’৯০-এ দেশে ফিরে বোন হাসিনাকে দেশসেবার সুযোগের জন্য, সরকারপ্রধান হওয়ার জন্য এক রাতে মোহাম্মদ নাসিমের কাজিপুরের সীমান্ত থেকে পিরোজপুরের পাড়েরহাট পর্যন্ত গেছি, উল্কার মতো সারা দেশ ছুটে বেড়িয়েছি, শোকাবহ ১৫ আগস্ট পালনের জন্য জনগণের দোয়ার জন্য পক্ষকাল টুঙ্গিপাড়া ঝড়বৃষ্টি-তুফানে কাজ করেছি সেই অধিকার থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনার পক্ষে দেশবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নেবেন সেটা তিনিই জানেন। কিন্তু আমি মনে করি আল্লাহর কাছে, মানুষের কাছে বোনের জন্য যে কোনো ভালোমন্দের জন্য ক্ষমা চাইবার অধিকার আমার আছে। সে অধিকার থেকেই চেয়েছি।
জীবনে এই প্রথম শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনের একটি শব্দও না প্রিন্ট মিডিয়ায়, না ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়-ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কোথাও আসেনি, কোথাও প্রচার হয়নি। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে লতিফ ভাই বলেছিলেন ‘ঢাকা যাব, বজ্র তুই যাবি নাকি?’ বলেছিলাম, নিশ্চয়ই যাব। আমি রাত ৮টা-সাড়ে ৮টায় রওনা হতে চেয়েছিলাম। লতিফ ভাই সাড়ে ৬টায় রওনা হয়েছিলেন। আমি তাঁকে কখনো কোনো দিন কোনো কাজে বাধা দিইনি। টাঙ্গাইল থেকে আমরা খুব শান্তিতে নিরাপদে সাভার পর্যন্ত পৌঁছে ছিলাম। সাভার মিলিটারি ডেইরি ফার্মের দেড়-দুই শ গজের মধ্যে কয়েকটি নেশাখোর কয়েক টুকরো কাঠে আগুন দিয়ে রাস্তা বন্ধ করেছিল। আমরা দূর থেকে লক্ষ্য করিনি। কাছাকাছি গেলে বেশ কয়েকটি ঢিল ছোড়ে। আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসি। আমার গাড়ির পেছনের একটি কাচ ভেঙে যায়। কেন যেন কিছুই মনে হয়নি। তবে সেখানে না সাধারণ ছাত্রছাত্রী ছিল, না জামায়াত-বিএনপি বা অন্য দলের কেউ ছিল। ১০-১২ জনের বেশি হবে না, অনেকের গায়ে জামাকাপড়ও ছিল না। দেশে কারফিউ চলছিল। পূর্ব-উত্তর দিকে শতেক গজের মধ্যে সাভার থানা। কিন্তু একেবারে সাভারের প্রাণকেন্দ্রে ১০-১২টা ন্যাংটা ছেলে মূল রাস্তায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে এটাকে সরকারি উদাসীনতা ছাড়া আর কী বলা যায়?
২১ তারিখ একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় সাক্ষী হতে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলাম। ’৯০-এর আগে আমি কখনো সুপ্রিম কোর্টে যাইনি। ’৯০-এর পর নির্বাচনি মামলা নিয়ে দু-এক বার হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে গেছি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেত্রকোনার মানুষ। তাঁর বাবা আখলাকুল হোসাইন আহমেদ এমপি ভীষণ ভালোমানুষ ছিলেন। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার প্রতিবাদে আমি যখন মেঘালয়ের পাদদেশে উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছি তখন প্রধান বিচারপতির বাবা প্রায় দুই বছর আমাকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। মহাদেও-নিলুয়াগিরি-ধরমপাশা যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সেখানেই তাঁকে পাওয়া গেছে। চাল-ডাল-আলু-পিঁয়াজ-মরিচ, খাবারদাবার, টাকাপয়সা যেভাবে পেরেছেন সাহায্য করেছেন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং দিনাজপুরের রহিম ভাইয়ের ছেলে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত মনে হয়েছে, ভালো লেগেছে। কত হবে আড়াই-তিন শ আইনজীবীর বসার জায়গা না হলেও দেড়-দুই হাজার আইনজীবী হাজির ছিলেন। কয়েকজন ক্যামেরাম্যান, দু-চার জন সংবাদ প্রতিনিধি আর আমরা দুই ভাই। আজাদকেও থাকতে দেওয়া হয়নি। আজাদ খুশিমনেই বেরিয়ে গিয়েছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে সওয়াল করেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বড় ভাই ও আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলছিলেন, ‘আপনার লেখা সব সময় পড়ি।’ অ্যাটর্নি জেনারেলের সওয়ালে ছিল কোটা আমরা চাই না, ২০১৮ সালে যা ছিল তাই থাকুক। তাহলে অতগুলো লোক ক্ষয় হলো কেন? এত ধ্বংস হলো কেন? প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম, বিচারপতি কাশেফা হোসেনকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চ কয়েকজনকে তাঁদের মতামত দেওয়ার জন্য ঠিক করেছিলেন। তার মধ্যে প্রবীণ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, শাহ মঞ্জুরুল হক, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম, ব্যারিস্টার আহসানুল করিমের বক্তব্য শোনেন। মনসুরুল হক চৌধুরী এক অসাধারণ উপস্থাপনা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কী, কেন, তাদের কেন সম্মান করা উচিত। প্রধান বিচারপতির কোর্টে সেদিনের শতকরা ৮০ জনই ছিলেন আওয়ামী সমর্থিত আইনজীবী। তার পরও যে মনোভাব দেখেছি ভালো লাগেনি। তবে দু-একটা বিষয় নতুন করে স্পষ্ট হয়েছে, কোটা বলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কখনো কিছু ছিল না, এখনো নেই। সব সময় মেধারই প্রাধান্য ছিল, এখনো সেটাই থাকল। অনেকের ধারণা সবকিছুতে কোয়ালিফাই করে ভাইভার সময় হয়তো মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু আসল ব্যাপার তা-ও না। যে কোনো সরকারি পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে, পরীক্ষায় পাস করতে হবে, ভাইভায় পাস করতে হবে। সবকিছুতে ঠিকঠাক কোয়ালিফাই করলে তারপর সেই পাস করাদের মধ্যে কোটায় যতজন থাকে প্রথম তাদের নেওয়া হবে-এই হলো কোটার সুবিধা। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১২-১৩ শতাংশের বেশি মুক্তিযোদ্ধা কোটা কখনো পূরণ হয়নি। যাদের কোটার সুযোগ আছে তারা কিন্তু কারও কাছ থেকে প্রশ্নপত্র কিনে পাস করে না। তারা তাদের কোটার ধান্ধায়ই থাকে। তাই ড্রাইভার, পিয়নের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে মেধাবীরা যে বছরের পর বছর ধরে মেধার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন তাদের কী হবে? আলোচনায় এও এসেছে মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর, না অগ্রসর? তারা পিছিয়ে পড়া, না অগ্রগামী? মুক্তিযোদ্ধারা যে সবার মাথার মুকুট এটা বলতে কারও বাধেনি। আর মুক্তিযোদ্ধারা যে সামাজিক আর আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া এটাও আকার-ইঙ্গিতে ফুটে উঠেছে। রায় হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, অন্যদের জন্য আরও ২ শতাংশ। এটা ১৫ শতাংশ হলেও সবাই মেনে নিত। এটাও মেনে নেবে। কিন্তু এর মাঝে যে কিয়ামত হয়ে গেল তার জবাব কে দেবে? আওয়ামী লীগের বর্তমান এক নেতা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী যে অসংলগ্ন কথা বলেন এমনিতেই তাতে অশান্তি সৃষ্টি হয়। ভদ্রলোক সব সময় চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। বাংলার মানুষ চিবিয়ে কথা বলে না, চিবিয়ে সব ধরনের খাবার খায়। সেদিন আমির হোসেন আমুর মতো একজন প্রবীণ নেতাকে বগলে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেভাবে দেখামাত্র গুলি চালানোর কথা বললেন, এটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ বা একজন নেতা বা মন্ত্রীর কথা হতে পারে না। মন্ত্রী হলেই কেউ গুলি চালানোর হুকুম দিতে পারেন না। গুলি চালানোর হুকুম ছোটরাও দিতে পারে। বড় হলেই দেখামাত্র গুলির হুকুম দেওয়া যায় না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জীবনের সিংহভাগ আপনার পিতার নির্দেশে পার করেছি। আর যে কদিন বেঁচে থাকব পিতাকে বুকে ধারণ করেই থাকব। তাই আপনার কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ-বাড়ির চারপাশে ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে থাকা কোনো সম্মানের নয়, আকাশে হেলিকপ্টার উড়িয়ে পাহারা দেওয়া, টিয়ার গ্যাস ছোড়া এসব একটা দেশের জন্য খুব একটা সম্মান বয়ে আনে না।
মেহেরবানি করে আপনি সবাইকে ডাকুন, একটা সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করুন। দেশ শুধু ১৪ দলের নয়, দেশ বিএনপি-জামায়াতের নয়, দেশ বাংলার আপামর জনসাধারণের। আপনি সবাইকে ডেকে কথা বলুন, দেখবেন খুব সহজেই হিমালয়সম সমস্যা তৃণমূলসম হয়ে গেছে, দেশে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। মেহেরবানি করে একটু ভেবে দেখুন। আমার বড় ভয়, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগে রাস্তাঘাটে ট্যাংক দেখেছিলাম। আমার মৃত্যুর ভয় নেই। যুদ্ধ ক্ষেত্রের বাইরে লোকালয়ে ট্যাংক, কামান-সাঁজোয়া গাড়ি দেখলে কেন যেন খারাপ লাগে। আশা করি আমার খারাপটা আপনি বুঝবেন।